জসিম মাহমুদ, টেকনাফ:

মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে প্রাণে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। নৌকায় করে পালাতে গিয়ে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী তোলাই এ দূঘর্টনা ঘটছে। নিখোঁজ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ। ভেসে আসছে নিখোঁজদের মৃত দেহ। স্বজন হারা রোহিঙ্গাদের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সমুদ্রসৈকতে আহাজারি ও কান্নাররোল পড়েছে।

গতকাল ভোররাতে নাফনদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বদরমোকাম এলাকায় রোহিঙ্গাদের বহন করা নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ১১জনের লাশ উদ্ধার করার খবর পাওয়া গেছে।

প্রাণ বাঁচাতে অতি ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে পরিবারের সাত সদস্যের সঙ্গে প্রায় ৩৫জনের মতো রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশ পালিয়ে আসছিলেন রোহিঙ্গা নারী রহিমা বেগম। তার সকলের বাড়ি মিয়ানমার মংডু শহরের হাসুরাতা গ্রাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পুরো পরিবারকে নিয়ে আর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। নৌকা ডুবিতে তার সঙ্গে সাঁতারিয়ে কূলে উঠতে পেরেছেন মেঝ ছেলে বশির উলাহ। অন্য সদস্যরা নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন। এমন কি বুধবার সকাল নয়টা পর্যন্ত নৌকা ডুবিতে পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেলেও তার পরিবারের কোন সদস্যের মৃত দেহ পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে ছিলেন-স্বামী রবি আলম, মেয়ে বড় হামিদা বেগম, মেঝ মেয়ে রুবিনা বেগম, ছোট ছেলে রশিদ উলাহ ও তার মা নুর জাহান এবং মেঝে ছেলে বশির উলাহ। তিনি ও মেঝ ছেলে ছাড়া তার পরিবারের পাঁচজনের এখন পর্যন্ত কারো মৃত দেহ পাওয়া যায়নি।

পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে হারিয়ে রহিমা বেগম আহাজারিতে শুধু স্বামী, ছেলে-মেয়ে ও মা হারানোর কথা বার বার বলছেন। এখন কার আশায় বাংলাদেশে থাকবেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন।

সরেজমিনে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চরে গিয়ে দেখা যায়, সমুদ্রসৈকতে জোয়ারের গর্জনের সঙ্গে দূর থেকে একনারী বিলাপের ধবনি ভেসে আসছে। একটু সামনে যেতেই দেখা গেল পানিতে ভিজা পরনের কাপড়ে ও কোলে আনুমানিক পাঁচ বছরের বয়সের লাল ও কালো রংঙের স্যুটার পরিহিত একজন শিশুকে (মেঝছেলে বশির উলাহকে) কোলে নিয়ে সৈকতে হেঁটে হেঁটে বিলাপ করছেন রহিমা বেগম। আর বলছেন, এ রকম হবে আগে জানলে মর্গের হাতে সবাইকে নিয়ে গ্রামে থেকে যেতাম। এ কষ্ট আমি এখন রাখব কোথায় ?

নৌকা ডুবির ঘটনায় স্বজন হারানোর বেদনায় মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা জীবিত উদ্ধার লোকজনের আহাজারি থামছে না কিছুতেই। সৈকতে পাড়ে আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা। চোখের কান্নায় অশ্র যেন থামছে না। শুধু সৈকতে ছুঁটাছুঁটি করছে নিখোঁজদের পাওয়ার আশায়।

একই এলাকা থেকে পালিয়ে আসা নারী মোহছেনা বেগমের কোলে ছয় বছরের শিশু নুর হোসেন। নৌকা ডুবিতে তার তিন বছরের মেয়ে সাহারা খাতুন নিখোঁজ রয়েছে। মেয়ের খোঁজে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচরের সৈকতে ছেলেকে কোলে নিয়ে আহাজারিতে পাগলের মতো কান্নাররোল পড়েছে। কিছুতেই থাকছে না তার কান্না। মোহছেনা বেগম বিলাপ করে বলছেন, এখন কোথায় যাবো, মা বলে ডাকবে কে। গত বছরের অক্টোবর মাসে শশুড়বাড়ি বলিবাজার বেড়াতে গিয়ে সে দেশের সেনা বাহিনী হাতে আটক হওয়ার পর থেকে অদ্যবধি স্বামী কাদের হোসেন নিখোঁজ রয়েছে। এরপর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কোন ভাবে সংসার চালিয়ে আসলেও গত আগস্ট মাসে ১১ তারিখের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াই গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে পালিয়ে আসার সময় নৌকায় উঠি। কিন্তু সেই নৌকাটি ডুবে গেলে মেয়ে সাহারা খাতুন নিখোঁজ হয়ে পড়েন।

মিয়ানমারের মংনিপাড়া থেকে আসা আরেকটি পরিবারের তিন বোন ও এক ভাই। বোন জুলেখা বেগম, জমিলা বেগম, আয়েশা বেগম ও সাইফুল ইসলামকে দেখা গেল আহাজারি করতে। তাদের মা ছেনুয়ারা বেগম নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁরা তিনবোন ও একভাইয়ের আহাজারিতে সৈকত এলাকার আকাশ-বাতাসও কান্নাকাটি করছে। তাদের বাবা কবির আহমদ দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা যায়।

তারা বলেন, যুবতী দুই বোন থাকায় ওই পাড়ে সবসময় সেনা ও নাডালা বাহিনীর ধর্ষণ ও নিয়ার্তন আতঙ্কে ছিলাম কিন্তু এ পাড়ে এসে আহাজারি ও কান্নার রোলে পড়ে গেলাম।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন খান বলেন, ‘গত ৩০ আগস্ট থেকে (আজ ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার পর্যন্ত) ছোট ছোট নৌকায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে নাফনদী ও সাগরে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার পর্যন্ত ৫৭জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। (বুধবার) বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আরও ১১জন রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষের মৃত দেহ উদ্ধার করেছেন স্থানীয় লোকজন। উদ্ধার লাশগুলো স্থানীয় ইউপির সদস্যদের দিয়ে স্ব স্ব এলাকায় দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।